কলকাতা হাইকোর্টের বিচারপতি দেবাংশু বসাক এবং বিচারপতি মহম্মদ সব্বার রশিদীর ডিভিশন বেঞ্চ যে রায় দিয়েছেন তাতে গত ৩ বছরে রাজ্য রাজনীতিতে সবচেয়ে আলোড়ন তোলা বিষয় নিয়ে দুর্নীতি মামলা, প্রাথমিক স্কুল, অর্থাৎ টেট, এসএসসি, অর্থাৎ মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক মিলিয়ে এই চাকরি হারাবে বেশিরভাগই। ২০১৬ সালের প্যানেলের ভিত্তিতে বেআইনিভাবে নিয়োগ করা হয়েছিল বলে ডিভিশন বেঞ্চের রায়ে বলা হয়েছে।
একইসঙ্গে বিচারপতিরা জানিয়ে দিয়েছেন এই নিয়োগ দুর্নীতি মামলার সঙ্গে যাঁরা জড়িত, সে রাজ্য প্রশাসনের যারাই হোক না কেন, তাঁদের বিরুদ্ধে তদন্ত চালিয়ে যাবে সিবিআই এবং প্রয়োজনে তাঁদের নিজেদের হেফাজতে নিতে পারবে। স্বাধীনতার পর ভারতের ইতিহাসে এমন ঘটনা আগে কখনো হয় নি।
একইসঙ্গে আদালতে জানিয়েছে এসএসসির প্যানেলের মেয়াদ শেষের পর যাঁরা চাকরি পেয়েছেন তাঁদের চার সপ্তাহের মধ্যে সুদ-সহ সেই বেতন ফেরত দিতে হবে। সুদ হবে বছরে ১২ শতাংশ। একইসঙ্গে আদালতের নির্দেশ এসএসসি নিয়োগ প্রক্রিয়ায় যে সব ওএমআর সিট বা উত্তর পত্র এসএসসির ওয়েবসাইটে আপলোড করা হয়েছে, সেগুলি যাতে মানুষ দেখতে পান সেই ব্যবস্থা করতে হবে। আদালত জানিয়েছে তাঁদের পর্যবেক্ষণ ২০২১৬-এর প্যানেলে যাঁরা চাকরি পেয়েছিলেন, তাঁরা সবাই চাকরি পেয়েছেন প্যানেলের মেয়াদ শেষের পর। পাশাপাশি বিচারপতিদের নির্দেশ অতিরিক্ত শূন্যপদ নিয়োগের জন্য যাদেরই সিবিআই তদন্তের স্বার্থে মনে করবে তাদেরই হেফাযতে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করতে পারবে।
এরপরেই হাইকোর্টের চাকরি বাতিলের নির্দেশ বেআইনি, নির্দেশে চ্যালেঞ্জ করে উচ্চ আদালতে যাবেন বলে জানিয়েছেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। চিন্তা না করার কথা বলে চাকরি হারাদের পাশে থাকার বার্তা দিয়েছেন মুখ্যমন্ত্রী। তিনি বলেছেন, চাকরি বাতিল যাঁদের করা হয়েছে, তাঁদের জন্যে যতদূর লড়াই করার, করবেন। পাশাপাশি আদালতের দিকে কার্যত আঙ্গুল তুলে তাঁর মন্তব্য, এটা বিজেপির (ভারতের শাসক-দল) বিচারালয়, যা বলে দেয়, তাই রায় দেয়। বেনজিরভাবে আক্রমণ করে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বলেছেন, বিজেপি যেখানে বসে, সেখানেই রাজনৈতিক বিচার করে। অন্য কেউ জনস্বার্থ করলে দেবে তাঁদের জেলে পাঠানো হয়। কিন্তু বিজেপি জনস্বার্থ মামলা করলে তাঁরা ছাড়া পেয়ে যান। এটা আজ নয়, অনেক দিন ধরে চলছে বলে অভিযোগ করেছেন মমতা বন্দোপাধ্যায়। তৃণমূল সুপ্রিমো আরও বলেছেন, এটা বিচারপতিদের দোষ নয়। কেন্দ্রীয় সরকারের দোষ। তারা বিজেপির লোক দেখে দেখে এখানে বসিয়েছে। বিজেপি পার্টি অফিস থেকে যা বলে দেয়, সেই ড্রাফ্টটা আদালত করে দেয়।
এসএসসি-র নিয়োগ মামলায় সবার চাকরি বাতিল হলেও ক্যান্সার আক্রান্ত হওয়ায় মানবিকতার কারণে সোমা দাসের চাকরি বহাল রাখার সিদ্ধান্ত নিয়েছে কলকাতা হাইকোর্ট। ২০১৬ সালে নবম-দশম শ্রেণির শিক্ষক নিয়োগের পরীক্ষায় বসেছিলেন সোমা দাস। সেই নিয়োগের মেধাতালিকায় নাম থাকা সত্ত্বেও তাঁকে চাকরি দেওয়া হয় নি বলে অভিযোগ। সেই অভিযোগের ভিত্তিতে মামলা হয় হাই কোর্টে। তার মধ্যেই ২০১৯ সালে ক্যানসার ধরা পড়ে তাঁর। সে বছর ফেব্রুয়ারি থেকে ব্লাড ক্যানসারে ভুগছেন নলহাটির পাইকপাড়া গ্রাম পঞ্চায়েতের আশ্রমপাড়া গ্রামের মেয়ে সোমা। কিন্তু লড়াই ছেড়ে দেন নি তিনি। চাকরির দাবিতে রোদ, বৃষ্টি মাথায় নিয়ে অসুস্থ সোমা দিনের পর দিন কলকাতার রাস্তায় ধর্না, অবস্থান বিক্ষোভ করে গিয়েছেন। নিয়োগ দুর্নীতি মামলার শুনানির সময়ে সোমার সঙ্গে আলাদা করে কথা বলেছিলেন তদানীন্তন বিচারপতি অভিজিৎ গঙ্গোপাধ্যায়। শিক্ষকতা করা ছাড়া সোমা অন্য কোনও সরকারি চাকরিতে আগ্রহী কিনা তা জানতে চেয়েছিলেন তিনি।
আর কলকাতা হাই কোর্টের প্রাক্তন বিচারপতি তথা বিজেপি নেতা অভিজিৎ গঙ্গোপাধ্যায় এসএসসি মামলার রায় ঘোষণার পরে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের পদত্যাগ দাবি করেছেন। তিনি হাই কোর্টের রায়কে স্বাগত জানিয়ে বলেছেন, যাঁরা যোগ্য প্রার্থী তাঁদের বঞ্চিত করা হয়েছে। তাঁদের ঠকিয়েছেন এই মিথ্যাচারী মুখ্যমন্ত্রী। বঞ্চিতদের মধ্যে হিন্দু, মুসলমান সকলে আছেন। সকলের উচিত, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে বয়কট করা। মুখ্যমন্ত্রীকে এখনই পদত্যাগ করতে হবে। অভিজিৎ গঙ্গোপাধ্যায় বলেছেন তাঁর খারাপ লাগছে, এমন এক জন মুখ্যমন্ত্রীর রাজ্যে আছেন, যিনি জোচ্চুরিকে প্রশ্রয় দেন। বিন্দুমাত্র লজ্জা থাকলে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের পদত্যাগ করা উচিত। রাষ্ট্রপতি শাসনের অধীনে নির্বাচন হওয়া উচিত। উল্লেখ্য, হাই কোর্টের বিচারপতির পদ থেকে ইস্তফা দিয়ে ৭ মার্চ বিজেপিতে যোগ দান করেন অভিজিৎ গঙ্গোপাধ্যায়। লোকসভা নির্বাচনে তমলুক কেন্দ্র থেকে তাঁকে প্রার্থী করেছে বিজেপি। অভিজিৎ গঙ্গোপাধ্যায় বলেছেন, দেশের বিচারব্যবস্থা সাধারণত অবিচার থেকে নিজেকে সরিয়ে রাখে। কলকাতা হাই কোর্টের বিচারপতিরাও সেই কাজ করেছেন। এখন আনন্দের দিন নয়। বলেছেন, তিনি যখন বিচার করছিলেন, অনাচার ধরা পড়েছিল। আবার ধরা পড়েছে। উপযুক্ত রায় দিয়েছে আদালত।
উল্লেখ্য, এসএসসি মামলার অগ্রগতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে অভিজিৎ গঙ্গোপাধ্যায়ের। তিনিই প্রথম এই মামলা শোনেন এবং ৮ হাজার ১৬১টি চাকরি বাতিলের নির্দেশ দেন। ডিভিশন বেঞ্চেও সেই নির্দেশ বহাল ছিল। পরে রাজ্য সুপ্রিম কোর্টে যায়। সেখান থেকে এসএসসি মামলা আবার ফেরানো হয় হাই কোর্টে। বিশেষ বেঞ্চ গঠন করে মে মাসের মধ্যে বিচারপ্রক্রিয়া শেষের নির্দেশ দিয়েছিল শীর্ষ আদালত। সাড়ে তিন মাসেই সেই প্রক্রিয়া শেষ হয়েছে। ২০ মার্চ বিচার শেষে রায় স্থগিত রেখেছিল আদালত।
অন্যদিকে, চাকরি চুরি, ঘুষ দিয়ে চাকরি ইস্যুতে গত ৩ বছর ধরে সরব রাজ্য রাজনীতি। ন্যায্য চাকরির দাবিতে, প্যানেল ভুক্ত হাজারো চাকরিপ্রার্থী দিনের পর দিন, এগারশো দিনের বেশি সময় ধরে ধরণা দিয়েছেন। একটা সময় রাজ্যের প্রাক্তন শিক্ষামন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায়ের বান্ধবীর বাড়ি থেকে ৫০ কোটি টাকা এবং প্রচুর সোনা আটক হওয়ার পর অস্বস্তিতে পড়ে যায়, রাজ্যের শাসক দল তৃণমূল কংগ্রেস। অবস্থা সামাল দিতে, রাজ্যের তরফে অতিরিক্ত পদ সৃষ্টি করার ব্যবস্থাও করা হয়। কিন্তু আদালতে তা আটকে যায়।
এই অবস্থায়, আনন্দ, স্বস্তি, আশা একইসঙ্গে আশঙ্কা। এসএসসি মামলায় রায়ের পর হাইকোর্ট চত্বরে জমা হওয়া হাজারো চাকরি প্রার্থীদের মনের অবস্থা সোমবার সকালে ভিন্ন প্রকৃতির। সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশে মামলা ফিরেছিল কলকাতা হাইকোর্টে। কিন্তু না আঁচালে বিশ্বাস নেই। তাই ১ হাজার ১৩৫ দিন ধরে ধর্মতলার গান্ধীমূর্তির তলায় যারা বসে আন্দোলন চালিয়ে গেছেন ঝড়-জ্ল-বৃষ্টি উপেক্ষা করে, তাদের এখন একটাই দাবি, যত শীঘ্র সম্ভব নিয়োগ প্রক্রিয়া চালু হোক। হাইকোর্টের রায় শুনেই ধর্নামঞ্চে থাকা চাকরিপ্রাপকদের চোখে জল। আন্দোলনকারী রাসমণি পাত্র যিনি ক’দিন আগে নিয়োগ দুর্নীতির প্রতিবাদে মাথার চুল কমিয়ে ফেলেছিলেন তিনি কাঁদতে কাঁদতে বলেছেন, তাঁদের আশা আন্দোলনকারীদের প্রতিও হাইকোর্ট যেন মানবিক দৃষ্টিভঙ্গি বজায় রাখে। পাশাপাশি তাঁদের বক্তব্য, অযোগ্যদের চাকরি বাতিল হয়েছে, কিন্তু যোগ্য চাকরিপ্রাপকদের কী হবে? তাই আদালতের পরবর্তী নির্দেশের দিকে তাকিয়ে রয়েছেন তাঁরা।
কিন্তু বিষয়টি যে সহজ হচ্ছে না, স্পষ্ট হয়ে গেছে, রায়দানের কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই। কলকাতা হাই কোর্টের রায়কে চ্যালেঞ্জ করে সুপ্রিম কোর্টে আবেদন করা হবে, জানিয়ে দিয়েছেন এসএসসির চেয়ারম্যান সিদ্ধার্থ মজুমদার। জানিয়েছেন, উচ্চ আদালতের রায়ে তিনি খুশি নন। তাঁর প্রশ্ন, পাঁচ হাজার জনের বিরুদ্ধে অবৈধভাবে চাকরি পাওয়ার অভিযোগ উঠেছে, তার জন্য প্রায় ২৬ হাজার জনের কেন চাকরি বাতিল হবে?
পাশাপাশি, ২০১৬-এর প্যানেলের চাকরি বাতিলের দাবিতে লড়ে গেছেন, শুনতে হয়েছে আন্দোলনকারীদের বিপদে চালিত করছেন। শুনতে হয়েছে একটার পর একটা মামলা করে বিষয়টিকে গুলিয়ে দেওয়ার চেষ্টা হয়েছে। আর হাইকোর্টের ডিভিশন বেঞ্চ যখন জানিয়ে দিয়েছে ভোটের পরেই নিয়োগ প্রক্রিয়া শুরু করতে হবে তখন হাসি চাওড়া হচ্ছে আইনজীবী ফিরদৌস শামিম-সহ অন্যান্যদের। বিচারপতিরা একইসঙ্গে ২৩ লক্ষ পরীক্ষার্থীর ওএমআর শিট পুনর্মূল্যায়নের নির্দেশ দিয়েছেন। হাইকোর্টের ডিভিশন বেঞ্চ জানিয়েছে লোকসভা ভোটের পরই টেন্ডার ডেকে শুরু করতে হবে নিয়োগ প্রক্রিয়া, নির্দেশ হাইকোর্টের।
ওদিকে আবার ১২ শতাংশ সুদ-সহ চার সপ্তাহের মধ্যে বেতন ফেরতের নির্দেশ দেওয়ার পর এখন ভয়ঙ্কর চাপের মুখে পড়েছেন চাকরি বাতিল হওয়া ২৫ হাজার ৭৫৩ জন। এসএসসির প্যানেলের মেয়াদ শেষ হয়ে যাওয়ার পরেও যাঁরা চাকরি পেয়েছেন, তাঁদের সুদ-সহ বেতন ফেরত দিতে বলার পর প্রশ্ন উঠতে শুরু করেছে ২০১৬-এর এসএসসিতে যারা চাকরি পেয়েছেন, তাঁদের সবারই চাকরির প্রায় ৮ বছর অতিক্রান্ত হয়ে গিয়েছে। আর এত লম্বা সময় ধরে পাওয়া মোটা অঙ্কের বেতন এবং ১২ শতাংশ হারে সুদ-সহ এক একজনকে চার সপ্তাহের মধ্যে ফেরত দিতে হবে কয়েক লক্ষ টাকা। এ বিষয়ে হাই কোর্টের বিচারপতি বসাকের ডিভিশন বেঞ্চের পর্যবেক্ষণ, জনগণের টাকায় বেতন পেয়েছেন ওই চাকরি-প্রাপকেরা। তাই বেতন তাঁদের ফিরিয়ে দিতে হবে। সেই সঙ্গে সুদও দিতে হবে। বেতনের পুরো টাকা তাঁরা ফিরিয়েছেন কি না, তা আদালতে জানাতে হবে সংশ্লিষ্ট আধিকারিকদের।