Feature

ভিসা জালিয়াতির সঙ্গে বাংলাদেশ হাইকমিশনের সংশ্লিষ্টতা নিয়ে তদন্ত করছে অস্ট্রেলিয়ান পুলিশ

এসবিএস বাংলা এক্সক্লুসিভ: বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়া স্বজনদের সাথে দেখা করতে গিয়ে ভিসা জালিয়াতির শিকার হয়েছেন অস্ট্রেলিয়ায় আশ্রয়প্রার্থী অসহায় রোহিঙ্গারা। ভিসা জালিয়াতির সঙ্গে ক্যানবেরাস্থ বাংলাদেশ হাইকমিশনের এক এমপ্লয়ির সংশ্লিষ্টতা আছে, ভুক্তভোগীদের এমন অভিযোগের ভিত্তিতে তদন্ত করছে পুলিশ।

Bangladesh High Commission, Canberra

Bangladesh High Commission, Canberra Source: Wikimedia

গত ছয় বছর ধরে অস্ট্রেলিয়ায় রোহিঙ্গা শরণার্থী হিসেবে বসবাস করছেন ফারুক*। তার মা এবং দুই বাচ্চাসহ তার স্ত্রী আছেন বাংলাদেশের কক্সবাজার শরণার্থী শিবিরে।

পরিবারের সাথে সময় কাটাতে ২০১৮ সালের ১৯ ডিসেম্বর ঢাকা যান তিনি; অস্ট্রেলিয়া থেকে সংগ্রহ করা ভিসাটিকে তিনি বাংলাদেশের টুরিস্ট ভিসা মনে করেছিলেন।

কিন্তু, অবৈধ/ ভুয়া ভিসায় ভ্রমণের অভিযোগে হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে ফারুককে আটক করে বাংলাদেশ ইমিগ্রেশন পুলিশ।
অনুসন্ধানে এসবিএস বাংলা জানতে পেরেছে যে, অস্ট্রেলিয়ায় বসবাসকারী অন্তত আরো ২০ রোহিঙ্গার মধ্যে সে-ও একজন, যারা সম্প্রতি ঢাকা আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে আটক হয়েছিল। অবৈধ ভিসায় ভ্রমণের অভিযোগে তাদেরকে অস্ট্রেলিয়ায় ফেরত পাঠানো হয়েছে।

ফারুকসহ আটক অন্য যাত্রীদের জিজ্ঞাসাবাদের পর, গত ২০ ডিসেম্বর অস্ট্রেলিয়ায় ফেরত পাঠিয়েছে বাংলাদেশ ইমিগ্রেশন পুলিশ। জিজ্ঞাসাবাদে তারা পুলিশকে জানায় যে, ক্যানবেরাস্থ বাংলাদেশ হাইকমিশনের একজন এমপ্লয়ির কাছ থেকে তারা ভিসাগুলো সংগ্রহ করেছেন।
Visa Fraud
Bangladesh airport immigration authority report detailing detained passenger's claims that Employee A had issued their tourist visas. Source: SBS Bangla
ঢাকায় বিমানবন্দর পুলিশের অভ্যন্তরীন একটি প্রতিবেদন দেখেছে এসবিএস বাংলা, যাতে ভুক্তভোগীদের বিবৃতি লিপিবদ্ধ রয়েছে।

একজন ইমিগ্রেশন কর্মকর্তার লিখিত সেই চিঠিতে বলা হয়েছে, ‍“যাত্রীদের বাংলাদেশি ভিসা সংগ্রহের বিষয়ে জিজ্ঞাসাবাদে তারা জানায় যে, অস্ট্রেলিয়ায় বসবাসরত মায়ানমারের নাগরিক এজেন্ট বি* মারফত জানতে পেরে তারা ক্যানবেরা হাইকমিশনে কর্মরত এমপ্লয়ি এ* এর নিকট পোস্ট অফিসের মাধ্যমে ট্রাভেল ডকুমেন্ট এবং ১৫০ ডলার পরিশোধ করে ভিসাসমূহ সংগ্রহ করেছেন।” 

ফারুক দাবি করেছেন যে, তাকে বলা হয়েছিল এক্সপ্রেস পোস্টের মাধ্যমে ট্রাভেল ডকুমেন্ট এমপ্লয়ি এ এর বাড়ির ঠিকানায় পাঠাতে।
Visa Fraud
Australia Post envelope in which Faruk sent his travel documents and money to Employee A. Source: SBS Bangla
“ক্যানবেরাস্থ বাংলাদেশ হাইকমিশনের এমপ্লয়ি এ আমাকে এই ভিসা দেন এবং আমি তাকে নগদ অর্থ দিয়েছি,” সিডনি ফিরে এসবিএস বাংলাকে এসব কথা বলেন তিনি।

“ভিসা পেতে ফিরতি চিঠির খামসহ ট্রাভেল ডকুমেন্ট আর ডলার পাঠাই এমপ্লয়ি এ এর বাসার ঠিকানায়।”

অস্ট্রেলিয়া পোস্টের মাধ্যমে এসবিএস বাংলা নিশ্চিত হয়েছে যে, এমপ্লয়ি এ এর নামের কেউ একজন স্বাক্ষর করে এই চিঠিটি গ্রহণ করেছেন।

হাতে লেখা (ম্যানুয়াল) ভিসা বাতিল

Visa Fraud
Bangladeshi High Commission in Canberra phased out manually filled in visas (left) in February 2018, replaced by machine-readable visas (right). Source: SBS Bangla
ফেব্রুয়ারি ২০১৮ থেকে হাতে লিখা ভিসার পরিবর্তে মেশিন রিডেবল ভিসা চালু করেছে ক্যানবেরাস্থ বাংলাদেশ হাইকমিশন। তবে তারা দাবি করছে যে, হাইকমিশনের অজান্তেই হাতে লেখা কিছু ভিসা ইস্যু করা হচ্ছিল।

অস্ট্রেলিয়ায় বসবাসরত অনেক রোহিঙ্গা এসবিএস বাংলা-কে বলেছেন যে, ইংরেজি ভাষার দুর্বলতা, আবেদন প্রক্রিয়া সম্পর্কে সঠিক জ্ঞান না থাকা এবং ভিসা প্রক্রিয়াকরণের দীর্ঘসূত্রিতার কারণে কমিউনিটির সহায়তা চাইতে বাধ্য হন তারা।

আমান উল্লাহ বলেন, বাংলাদেশের টুরিস্ট ভিসা পেতে পরিচিত একজন রোহিঙ্গাকে ৩৫০ ডলার দিয়েছেন। তিনি আরো দাবি করেন, তার ভিসাটিও ইস্যু করেছেন হাইকমিশনের এমপ্লয়ি এ

“ভুয়া ভিসা ইস্যুর কথা শুনে আমি বাংলাদেশ হাইকমিশনে যাই। সেখানে শামীমা পারভীন (দ্বিতীয় সচিব, বাংলাদেশ হাইকমিশন) আমাকে বলেছেন যে, এই ভিসাটা জাল। নতুন ভিসা পেতে হলে আগে পুলিশে রিপোর্ট করতে হবে, আমি তাই করি” বলেছেন আমান।

তিনি আরো বলেন, “আমরা চাই ভুয়া ভিসা বন্ধ হউক। সবাই যেন আসল ভিসায় বাংলাদেশ ভ্রমণে যেতে পারে।”

মোহাম্মদ ইদ্রিস দাবি করেন যে, যখন কমিউনিটির কিছু লোকজন তার কাছে সাহায্য চাইতে আসে, তিনি তাদেরকে ভিসা প্রক্রিয়া দ্রুত করতে ট্রাভেল ডকুমেন্ট এবং নগদ অর্থ এমপ্লয়ি এ এর বাড়ির ঠিকানায় পাঠাতে পরামর্শ দেন, তিনি বিশ্বাস করেছিলেন ভিসাগুলো বৈধ।

“তিনি একজন হাইকমিশন অফিসিয়াল। আমরা কিভাবে বুঝব যে তার ইস্যু করা ভিসাগুলো আসল না ভুয়া?”, বলেছেন তিনি।

রোহিঙ্গা কমিউনিটির প্রতিক্রিয়া

এসবিএস বাংলায় প্রকাশিত প্রথম সংবাদের পর রোহিঙ্গা কমিউনিটির অনেকেই এগিয়ে এসেছেন।

মেলবোর্নে বসবাস করেন অস্ট্রেলিয়ান নাগরিক আমিনা খাতুন। রোহিঙ্গা কমিউনিটিতে তিনি দোভাষী হিসেবে কাজ করছেন। তিনি বলেন, ভুয়া ভিসায় ভুক্তভোগী কয়েকজন তাকে জানিয়েছেন তাদের অভিজ্ঞতার কথা।
Visa Fraud
Screenshot claiming to show text message between Shawfikul Islam and Agent C showing Agent C's bank details, plus address of Employee A. Source: SBS Bangla
মেলবোর্নের শফিকুল ইসলামও সম্পৃক্ত আছেন অস্ট্রেলিয়ার রোহিঙ্গা কমিউনিটির সঙ্গে। শফিকুল দাবি করেন যে, তার কাছে প্রমাণ আছে এমন একজন এজেন্টের যে কিনা এমপ্লয়ি এ কে সাহায্য করেন।

এজেন্ট সি এর বিরুদ্ধে আমার কাছে প্রমাণ রয়েছে। সে এমপ্লয়ি এ এর সাথে কাজ করে। ভুয়া হওয়া সত্ত্বেও তারা টুরিস্ট ভিসা প্রতি ৩২০ থেকে ৬০০ ডলার নিয়ে থাকে।”

কতটুকু জানে অস্ট্রেলিয়ান কর্তৃপক্ষ?

২০১৮ সালের ডিসেম্বর মাসের শেষের দিকে, অন্তত ছয় জন রোহিঙ্গা শরণার্থী আনুষ্ঠানিক অভিযোগ করেছেন ক্যানবেরার উডেন পুলিশ স্টেশনে। তারা বলেছে, পুলিশ তাদের অভিযোগ নথিভুক্ত করেছে এবং একটি ইভেন্ট নম্বর দিয়েছে।

এসবিএস-কে পাঠানো এক বিবৃতিতে অস্ট্রেলিয়ান ফেডারাল পুলিশ (এএফপি) নিশ্চিত করেছে যে, ‘ভ্রমণের জন্য ইস্যু করা ভিসা জালিয়াতি সংক্রান্ত একটি অভিযোগ' গ্রহণ করেছে এসিটি পুলিশ, এ বিষয়ে তদন্ত চলছে।
Visa Fraud
Victims of the visa scam made an official complaint to ACT Police. Source: SBS Bangla
বাংলাদেশ হাইকমিশনার মোহাম্মদ সুফিউর রহমানও নিশ্চিত করেছেন যে, এ বিষয়ে অবগত আছে এএফপি।

“ঢাকা বিমানবন্দর থেকে যাদেরকে অস্ট্রেলিয়া ফেরত পাঠানো হয়েছে তাদের ভিসাগুলো আসল না ভুয়া এ বিষয়ে জানতে চেয়েছে এএফপি,” এসবিএস বাংলাকে বলেছেন তিনি।

বাংলাদেশ হাইকমিশনের বক্তব্য

এসব অভিযোগের প্রেক্ষিতে লিখিত বিবৃতিতে বাংলাদেশ হাইকমিশনার সুফিউর রহমান জানিয়েছেন যে, গত দুই সপ্তাহ ধরে অস্ট্রেলিয়ার কয়েকজন রোহিঙ্গা শরণার্থীর কাছ থেকে হাতে লেখা ভুয়া ভিসাসহ ট্রাভেল ডকুমেন্ট পেয়েছে হাইকমিশন।

“যদিও আমরা অভিযোগ পেয়েছি, তারপরও আমাদের কোনো কর্মকর্তার সংশ্লিষ্টতা রয়েছে কিনা তা সুনিশ্চিতভাবে বলতে পারছি না। সিডনি এবং মেলবোর্নের সম্ভাব্য কয়েকজন এজেন্ট ও হ্যান্ডলারের নাম পেয়েছি আমরা। এই ডকুমেন্টধারী রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশ ভ্রমণ এবং তাদের সম্পর্কে কর্তৃপক্ষ যে তথ্য পেয়েছে, তার ভিত্তিতে কয়েকজনকে ফেরত পাঠানো হয়েছে। এ সম্পর্কে বাংলাদেশের সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের বিস্তারিত প্রতিবেদনের জন্য অপেক্ষা করছি আমরা।”

এসবিএস বাংলার পক্ষ থেকে পাঠানো এমপ্লয়ি এ এর সংশ্লিষ্টতার অভিযোগ সম্পর্কে তিনি কোনো মন্তব্য করেননি। তবে তিনি স্বীকার করেছেন যে, ২০১৮ সালের এপ্রিল এবং নভেম্বর মাসে হাইকমিশনের দ্বিতীয় সচিব শামীমা পারভীন ভুয়া ভিসা ইস্যু হওয়া সম্পর্কে তাদের সতর্ক করেছিলেন।

জনাব রহমান এসবিএস বাংলাকে আরও নিশ্চিত করেছেন যে, ভুয়া ভিসাগুলোতে হাইকমিশনের দ্বিতীয় সচিব শামীমা পারভীনের স্বাক্ষর জাল করা হয়েছে।

“ঢাকা থেকে আমরা বেশ কিছু নমুনা পেয়েছি, সেগুলো পরীক্ষা করে দেখেছি যে স্বাক্ষরগুলো তার নয়,” বলেছেন তিনি। এ বিষয়ে তদন্ত চলছে বলেও জানান হাইকমিশনার।

“হাইকমিশন তদন্ত করে না। এ ব্যাপারে বাংলাদেশ কর্তৃপক্ষ কাজ করছে।”

*ছদ্ম-পরিচয় ব্যবহার করা হয়েছে।

Share
Published 11 January 2019 2:16am
Updated 15 November 2019 9:28am
By Hasan Tariq
Presented by Hasan Tariq


Share this with family and friends