নতুন সিটিজেনশিপ টেস্টের ঘোষণা দিল অস্ট্রেলিয়া

অস্ট্রেলিয়ান সিটিজেনশিপ ডে-তে সরকার ঘোষণা করেছে, নভেম্বরের মাঝামাঝি থেকে নাগরিকত্বের সমস্ত পরীক্ষায় অস্ট্রেলিয়ান মূল্যবোধ সম্পর্কিত একটি অংশ অন্তর্ভুক্ত করা হবে।

Indian-born Edward Quinn at his citizenship ceremony

Indian-born Edward Quinn at his citizenship ceremony with Labor MP Wayne Swan Source: Supplied

এক যুগেরও বেশি সময় পরে এই প্রথম অস্ট্রেলিয়ার সিটিজেনশিপ টেস্টে পরিবর্তন আনা হচ্ছে। অস্ট্রেলিয়ান মূল্যবোধের প্রতি জোর দেওয়া হচ্ছে এতে।

বৃহস্পতিবার অস্ট্রেলিয়ান সিটিজেনশিপ ডে-তে এ সংক্রান্ত ঘোষণায় অ্যাক্টিং মিনিস্টার ফর ইমিগ্রেশন, সিটিজেনশিপ, মাইগ্রান্ট সার্ভিসেস অ্যান্ড মাল্টিকালচারাল অ্যাফেয়ার্স, অ্যালান টাজ বলেন,

“আমাদের অস্ট্রেলিয়ান মূল্যবোধ গুরুত্বপূর্ণ। আমাদের দেশ গড়ার ক্ষেত্রে এগুলো সহায়তা করেছে। আর এগুলোর কারণেই বহু লোক অস্ট্রেলিয়ার নাগরিক হতে চান।”

১৫ নভেম্বর থেকে সিটিজেনশিপ টেস্টে কী কী অন্তর্ভুক্ত করা হবে? এ সম্পর্কে এক বিবৃতিতে মিস্টার টাজ বলেন,

“সম্ভাব্য নাগরিককে অনুধাবন করতে হবে এবং আমাদের মূল্যবোধগুলোর প্রতি প্রতিশ্রুতিবদ্ধ হতে হবে। যেমন, বাক স্বাধীনতা, পারস্পরিক সম্মানবোধ, সমান সুযোগ-সুবিধা, গণতন্ত্রের গুরুত্ব এবং আইনের শাসন।”

“যারা নাগরিকত্বের জন্য আবেদন করেন তাদেরকে আমরা বলি আমাদের জাতির প্রতি পরিপূর্ণ প্রতিশ্রুতিবন্ধ হওয়ার আগে আমাদের মূল্যবোধগুলো আরও গভীরভাবে অনুধাবন করতে।”

নাগরিকত্বের নতুন পরীক্ষায় কী ধরনের প্রশ্ন থাকবে?

আপডেট করা নাগরিকত্ব পরীক্ষায় ২০ টি বহু-নির্বাচনী প্রশ্ন থাকবে, যার মধ্যে থাকবে নতুন করে অন্তর্ভুক্ত করা অস্ট্রেলিয়ান মূল্যবোধ সংক্রান্ত ৫ টি নতুন প্রশ্ন। এই নতুন ৫ টি প্রশ্নের সবগুলোরই উত্তর সঠিক হতে হবে। আবেদনকারীকে এই পরীক্ষায় পাশ করতে হলে সবমিলিয়ে কমপক্ষে ৭৫ শতাংশ নম্বর পেতে হবে।

নাগরিকত্বের জন্য ইংরেজি ভাষা কিংবা রেসিডেন্সি বিষয়ক কোনো শর্তের পরিবর্তন করা হবে না।

অস্ট্রেলিয়ান মূল্যবোধ সংক্রান্ত নতুন সেকশনে প্রশ্নের উদাহরণ:

  • স্টেট ও ফেডারাল সংসদ নির্বাচনে ভোট প্রদান করা অস্ট্রেলিয়ার সকল নাগরিকের জন্য গুরুত্বপূর্ণ কেন?
  • অস্ট্রেলিয়ায় লোকজনের কি ইংরেজি শেখার প্রচেষ্টা চালানো উচিত?
  • অস্ট্রেলিয়ায়, আপনি যদি অপমানিত হন, তাহলে কি আপনি কোনো ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে সহিংসতার উস্কানি দিতে পারেন?
  • পারস্পরিক মত-বিরোধ দেখা দিলে লোকজনের কি সহিষ্ণুতা প্রদর্শন করা উচিত?
  • অস্ট্রেলিয়াতে লোকজন কাকে বিয়ে করবে কিংবা করবে না, সে বিষয়ে কি তারা স্বাধীন?
  • অস্ট্রেলিয়ায়, স্ত্রী যদি আনুগত্য না করে কিংবা অশ্রদ্ধা প্রদর্শন করে, তাহলে কোনো স্বামী কি তার স্ত্রীর সঙ্গে সহিংস আচরণ করতে পারেন?
  • লক্ষ্য কিংবা আগ্রহের বিষয়ে চেষ্টা-প্রচেষ্টার ক্ষেত্রে নারী-পুরুষের সমান সুযোগ পাওয়া উচিত বলে কি আপনি মনে করেন?
  • অস্ট্রেলিয়ায় মানুষের বাক-স্বাধীনতা এবং মত প্রকাশের স্বাধীনতার প্রতি সম্মান প্রদর্শন করা কি উচিত?
এগুলো পরীক্ষার হুবহু প্রশ্ন নয়। আর, সঠিক উত্তর বেছে নিতে হবে অনেকগুলো উত্তর থেকে।

এই পরীক্ষার প্রস্তুতি গ্রহণের জন্য অনলাইনে Australian Citizenship: Our Common Bond এর হাল-নাগাদ সংস্করন দেখুন।

নাগরিকত্বের গুরুত্ব কী?

এডওয়ার্ড কুইন-এর জন্ম ভারতে এবং বেড়ে ওঠা আবু ধাবিতে। মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং বিষয়ে পড়াশোনা করেছেন তিনি। মাস্টার্স ডিগ্রি করার জন্য তিনি অস্ট্রেলিয়াকে বেছে নেন।

ব্রিসবেনে বসবাসকারী ৩১ বছর বয়সী এই ব্যক্তি এসবিএস-কে বলেন,

“প্রাথমিকভাবে মূলত আমি পড়তে এসেছিলাম। এর বাইরে আমার অন্য কোনো পরিকল্পনা ছিল না।”
Mr Quinn
Mr Quinn is thrilled to be an Australian citizen. Source: Supplied
তিনি যখন আবিষ্কার করলেন যে, তার ডিগ্রি অস্ট্রেলিয়ার চোখে তাকে একজন দক্ষ কর্মী হিসেবে চিহ্নিত করছে, তিনি স্থায়ী অভিবাসনের জন্য পর্যাপ্ত পরিমাণ নম্বর অর্জন করেছেন এবং এভাবে তিনি পরবর্তীতে নাগরিকত্বও লাভ করতে পারবেন, তখন তিনি ভবিষ্যত নিয়ে পরিকল্পনা করেন।

মিস্টার কুইন-এর পার্মানেন্ট রেসিডেন্সির অনুমোদন পেতে মাত্র চার মাস সময় লেগেছিল। তবে, নাগরিকত্ব লাভের জন্য তাকে দীর্ঘ দিন অপেক্ষায় থাকতে হয়েছিল। অপেক্ষার সময়টিতে তিনি আরও একটি মাস্টার্স ডিগ্রি সম্পন্ন করেন, ইন্টেলেকচুয়াল প্রপার্টি ল’তে। এ দেশে আগমনের চার বছর পর, সিটিজেনশিপ টেস্টে অংশ নেওয়ার পর, তার নাগরিকত্বের দরখাস্ত মঞ্জুর হয়।

তিনি বলেন,

“ইমেইল পাওয়ার পর আমি এক ধরনের স্বস্তি অনুভব করি।”

“এই প্রক্রিয়া শেষ হয়েছে, এটা জানাটা স্বস্তিদায়ক। কারণ, আমি কোনো মাইগ্রেশন এজেন্ট নিযুক্ত করি নি কিংবা কোনো আইনজীবি বা কাউকেই নিযুক্ত করি নি। যাবতীয় মানসিক চাপ আমি নিজে বহন করেছি।”
অস্ট্রেলিয়ার নাগরিক হিসেবে তিনি ২৬ জানুয়ারি ২০১৮ তারিখে শপথ গ্রহণ করেন। এই দিনটির কথা তিনি কখনই ভুলবেন না, বলেন তিনি।

“আমি অত্যন্ত আনন্দিত হই এবং আত্মবিশ্বাস অনুভব করি। অনুষ্ঠানের পর আমি অনুভব করি যে, এখন আমি তাদের সামনে দাঁড়াতে পারবো যারা আমাকে বলেছিল, ‘নিজের দেশে ফিরে যাও’। এখন আমি তাদেরকে বলতে পারি, ‘আমি আসলে এখানকার লোক, আমি একজন অস্ট্রেলিয়ান’।”

“এটি যদিও একটি দেশ, আমি মনে করি, একজন ব্যক্তির মতোই অস্ট্রেলিয়া আমাকে সহায়তা করেছে এবং আমি অনেক কৃতজ্ঞ।”

তিনি আরও বলেন,

“আমি আসলে ডিফেন্স রিজার্ভস-এ নাম লিখিয়েছিলাম [প্রতিদান হিসেবে কিছু দেওয়ার জন্য]। দুর্ভাগ্যজনকভাবে আমি তাদের মেডিকেল মানদণ্ডের শর্ত পূরণ করতে পারি নি।”

স্থায়ী অভিবাসন এবং নাগরিকত্বের মধ্যে পার্থক্য কী?

সাধারণত পার্মানেন্ট রেসিডেন্টরা স্থায়ীভাবে অস্ট্রেলিয়ায় বসবাস করতে, কাজ করতে এবং পড়াশোনা করতে পারেন। তবে, তারা অস্ট্রেলিয়ান পাসপোর্ট পাওয়ার উপযুক্ততা লাভ করেন না।

স্থায়ী অভিবাসীদের অস্ট্রেলিয়ায় প্রবেশের ক্ষেত্রে কোনো স্বয়ংক্রিয় অধিকার থাকে না। তাদের কাছে অবশ্যই একটি বৈধ পার্মানেন্ট ভিসা থাকতে হবে, এর অন্যথা হলে তারা পার্মানেন্ট রেসিডেন্ট হিসেবে এদেশে ফিরে আসতে পারবেন না। অস্ট্রেলিয়ার নাগরিকেরা দেশে ছেড়ে যতবার খুশি বাইরে যেতে পারেন এবং এদেশে পুনঃপ্রবেশ করতে পারেন।
ফেডারাল, স্টেট কিংবা টেরিটোরি নির্বাচনে নাগরিকরা ভোট দিতে পারেন। তারা সাংবিধানিক গণভোট (রেফারেন্ডাম এবং প্লেবিসিট)-এ ভোট দিতে পারেন। তারা সংসদ নির্বাচনে অংশ নিতে পারেন এবং তারা অন্য দেশে তাদের সন্তানদের জন্য অস্ট্রেলিয়ার নাগরিক হিসেবে জন্ম-নিবন্ধনও করাতে পারেন।

বিদেশে সমস্যায় নিপতিত হলে অস্ট্রেলিয়ান দূতাবাসে কিংবা কনসুলেটে তারা সাহায্য প্রার্থনা করতে পারেন।

প্রতিবছর কতজন লোক অস্ট্রেলিয়ার নাগরিকত্ব গ্রহণ করেন?

১৯৪৯ সালে শুরু হওয়ার পর থেকে এ পর্যন্ত পাঁচ মিলিয়নেরও বেশি লোক অস্ট্রেলিয়ার নাগরিকত্ব গ্রহণ করেছেন। গত পাঁচ বছরে ৬৮৬,০০০ এরও বেশি লোক অস্ট্রেলিয়ার নাগরিক হয়েছেন। আর, ২০১৯-২০২০ অর্থ-বছরে নাগরিক হয়েছেন রেকর্ড-সংখ্যক ২০৪,০০০ ব্যক্তি।

কোভিড-১৯ বৈশ্বিক মহামারীর কারণে অস্ট্রেলিয়া জুড়ে অনলাইন সিরিমনির মাধ্যমে ৮৪,০০০ এরও বেশি লোক নাগরিকত্ব গ্রহণ করেছেন।
যে-সব দেশের লোকেরা অস্ট্রেলিয়ার নাগরিকত্ব গ্রহণ করেছেন সেগুলোর মধ্যে শীর্ষ-স্থানীয় পাঁচটি দেশ হচ্ছে, ভারত, যুক্তরাজ্য, চীন, ফিলিপিন্স এবং পাকিস্তান।

বুধবার মিস্টার টাজ-এর অফিস থেকে প্রকাশিত তথ্য অনুসারে, ২০১৯-২০২০ অর্থ-বছরে ২৭ শতাংশ বেশি ভিসা ইস্যু করা হয়েছে। তবে, এর বিপরীতে, ভিসার চাহিদা অনেক অনেক বেশি।

২০১৮ সালের তথ্য অনুসারে, মানুষ যদি স্বাধীনভাবে যেখানে খুশি সেখানে স্থানান্তরিত হতে পারতো, সেক্ষেত্রে অস্ট্রেলিয়ায় আগমনের সম্ভাব্য নেট মাইগ্রেশন ইনডেক্স ১৭৯ শতাংশ বৃদ্ধি পেত। অস্ট্রেলিয়ায় তাহলে এখন ৪৪ মিলিয়নেরও বেশি লোক বাস করতো। এখন এই সংখ্যা ২৪.৯৯ মিলিয়ন। এই সমীক্ষা চালিয়েছে গ্লোবাল অ্যানলিটিক্স কোম্পানি Gallup Migration Research Centre.
নাগরিকত্বের প্রচুর আবেদন জমে আছে। ৩১ আগস্ট পর্যন্ত প্রাপ্ত তথ্য মতে, ডিপার্টমেন্ট অফ হোম অ্যাফেয়ার্সের কাছে ১৫৯,৮৪৬ টি জেনারেল এলিজিবিলিটি সিটিজেনশিপ এপ্লিকেশন রয়েছে। এসব দরখাস্তের শতকরা ৭৫ ভাগ নিষ্পন্ন হতে সময় লাগে ১৫ মাস আর শতকরা ৯০ ভাগ ক্ষেত্রে সময় লাগে ২৮ মাস।

নাগরিকত্বের প্রক্রিয়াকরণে কোভিড-১৯ এর প্রভাব কী?

ডিপার্টমেন্ট অফ হোম অ্যাফেয়ার্স বলছে, কোভিড-১৯ বৈশ্বিক মহামারীর সময়েও নাগরিকত্বের আবেদনগুলোর প্রক্রিয়াকরণ থেমে নেই। ইন-পারসন বা ব্যক্তিগত উপস্থিতিতে অনুষ্ঠিত হওয়া সিটিজেনশিপ অ্যাপয়েন্টমেন্ট এবং টেস্টিংগুলো কয়েক মাসের জন্য স্থগিত রাখা হয়েছিল। তবে, মেলবোর্ন ছাড়া বাকি সব স্থানে এগুলো আবারও চালু করা হয়েছে।

কোভিড-১৯ এর ঝুঁকি ও নিষেধাজ্ঞাগুলোর কারণে যাবতীয় ইন-পারসন অনুষ্ঠানগুলো এ বছরের শুরুর দিকে স্থগিত রাখা হয়েছিল। এরপর, ৩১ মার্চ থেকে অনলাইন সিরিমনি চালু করা হয়। কিছু ফেস-টু-ফেস বা মুখোমুখি অনুষ্ঠান পুনরায় চালু করা হয় জুন মাসে।

এসবিএস নিউজকে ডিপার্টমেন্ট অফ হোম অ্যাফেয়ার্স জানায়, ইন-পারসন সিরিমনিগুলোর জন্য যে-সব স্থানে কোভিড-নিরাপদ ব্যবস্থা করা যাবে না সেসব স্থানে অনলাইন সিরিমনি ২০২০ এবং ২০২১ সালেও চলবে।

বৃহস্পতিবার অস্ট্রেলিয়ার বিভিন্ন স্থানে শতাধিক সিরিমনি অনুষ্ঠিত হবে এবং এগুলোতে ২,৫০০ এরও বেশি লোক নাগরিকত্ব গ্রহণ করবেন।

অস্ট্রেলিয়ায় বসবাসের জন্য আরও তথ্যের জন্য দেখুন

Follow SBS Bangla on .

Share
Published 17 September 2020 4:48pm
By Essam Al-Ghalib
Presented by Sikder Taher Ahmad


Share this with family and friends